ডিজিটাল আইনের মতোই অপব্যবহারের ঝুঁকি থাকছে সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশে। এতে বুলিং, ধর্মীয় উস্কানি, ওয়ারেন্ট ছাড়া পুলিশের গ্রেপ্তারের ক্ষমতা-সংক্রান্ত ধারাগুলোর মাধ্যমে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ফের কুক্ষিগত করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। অধ্যাদেশটি মূলত আগের ডিজিটাল বা সাইবার সিকিউরিটি আইনের পুনরাবৃত্তি হয়েছে।

মঙ্গলবার সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ নিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব আশঙ্কা তুলে ধরা হয়। সংবাদ সম্মেলনে অনলাইনে যুক্ত হয়ে মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি অব মালয়ার আইন ও উদীয়মান প্রযুক্তি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মুহাম্মদ এরশাদুল করিম পর্যালোচনা ও সুপারিশ তুলে ধরেন। 

বিশ্লেষণে বলা হয়, অধ্যাদেশে সাইবার সুরক্ষা এজেন্সির মহাপরিচালক ও পুলিশকে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তা সাইবার নিরাপত্তা আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এখানে অনেক শব্দের ব্যাখ্যা নেই, ভাষা দুর্বোধ্য। এতে অপব্যবহারের সুযোগ তৈরি হবে। ধারা ৮, ২৫, ২৬, ৩৫ আগের মতো নিবর্তনমূলক। এ ধরনের আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা ও দেশের বিদ্যমান দক্ষতা বিবেচনায় না নিয়ে, এমনকি অংশীজনকে কেন সম্পৃক্ত করা হলো না, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এটা একটা জগাখিচুড়ির অধ্যাদেশ হয়েছে। সাইবার, ইন্টারনেট, ডিজিটাল– সব মিলিয়ে জগাখিচুড়ি করেছে। সাইবার সুরক্ষা নাম হলেও আগের ডিজিটাল নিরাপত্তা ও সাইবার নিরাপত্তা আইনের এক ধরনের পুনরাবৃত্তি এটি। বাক্‌স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রশ্নে এটি নিয়ন্ত্রণমূলক ও নজরদারির অধ্যাদেশে পরিণত হয়েছে। ডিজিটাল অধিকারের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু পুরো অধ্যাদেশে অধিকারের কোনো প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। বরং মতপ্রকাশকে খর্ব করার প্রক্রিয়া দেখা যায়, যা গ্রহণযোগ্য নয়।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, একটি বৈঠকে সরকারের পক্ষ থেকে অঙ্গীকার ছিল, সাইবার আইন বাতিল হবে, যা তারা করেছে। সবার অংশগ্রহণ প্রক্রিয়ায় আইন হবে, সে কথাও ছিল। কিন্তু সেখান থেকে কেন সরে এলো, সেটা গ্রহণযোগ্য নয়। 

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ধর্মীয় মূল্যবোধের ব্যাখ্যা থাকতে হবে। পাশাপাশি অসাম্প্রদায়িক মানুষের সমঅধিকার ও বৈষম্যবিরোধী চেতনার বিষয় থাকতে হবে। সার্বিকভাবে ঢেলে সাজানোর আগে অধ্যাদেশটি গ্রহণযোগ্য নয়। এতে জনস্বার্থের প্রতিফলন নেই। বরং মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব হবে।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এ আইনের দরকার আছে। বরং একাধিক আইনের প্রয়োজন। কিন্তু তড়িঘড়ি করে করা হয়েছে। বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে এভাবে অনুমোদন হওয়ায় হতবাক হয়েছি।

সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অধ্যাদেশটির সম্ভাব্য ব্যবহার প্রসঙ্গে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এখানে বিগত সরকারের বয়ানের প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। আগের দুটি আইনেও বলা হয়েছিল, তা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে যাবে না। এবারও সেই একই কথা শোনা গেল। কিন্তু অনুমোদিত অধ্যাদেশে তা দেখা যাচ্ছে না। এভাবে আইন হয়ে গেলে তা সংবাদমাধ্যমসহ সব মানুষের তথ্য প্রকাশের স্বাধীনতা, বাক্‌স্বাধীনতা ও সংগঠনের স্বাধীনতা ঝুঁকিতে পড়বে।

টিআইবি জানিয়েছে, সংস্থার এই বিশ্লেষণ সরকারের কাছে পাঠানো হবে। সরকার যেন এটিকে বিবেচনায় নিয়ে সবার অভিমত নিয়ে আইন করে।

অনুমোদিত অধ্যাদেশের খসড়া সরকারের কোনো ওয়েবসাইটে না থাকার প্রসঙ্গ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন পরিচালক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, যে মন্ত্রণালয়ের অধীনে হচ্ছে, তাদের দায়িত্ব ছিল এটি তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা। এটা নিয়ে লুকোছাপা করার কিছু নেই, উন্মুক্ত করা উচিত।

সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক সুমাইয়া খায়ের।

প্রসঙ্গত, গত ৭ নভেম্বর উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিলের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। ১ ডিসেম্বর সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের ওয়েবসাইটে সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৪-এর খসড়া প্রকাশ করে ৪ ডিসেম্বরের মধ্যে মতামত চাওয়া হয়। ২৪ ডিসেম্বর উপদেষ্টা পরিষদ অধ্যাদেশের খসড়া অনুমোদন দেয়।