সঠিক পরিসংখ্যানের ঘাটতিতে কৃষির অর্জন ম্লান হচ্ছে

গত পাঁচ দশকে দেশের কৃষি খাতের অর্জন বেশ ঈর্শনীয়। তবে সামনের দিনের চ্যালেঞ্চ রয়েছে অনেক। সেগুলো মোকাবেলা করেই দেশের খাদ্য নিরাপত্তা কৃষকের স্বার্থ ও দেশের অর্জন ধরে রাখতে হবে। তবে সঠিক পরিসংখ্যানের ঘাটতিতে কৃষির অর্জন ম্লান হচ্ছে। বাজারে কৃষি পণ্যের ঊর্ধমুখি দাম, চাহিদার বিপরীতে ঘাটতিসহ নানা সমস্যা রয়েছে। তবে সেগুলো সমাধানের জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হলে প্রয়োজন সঠিক পরিসংখ্যান। সেটি না থাকায় আমদানির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হয়। ফলে বর্তমানের কৃষি অর্জন ধরে রাখতে হলে পরিসংখ্যান আরো সঠিক ও দ্রুত প্রকাশ করতে হবে।

বাংলাদেশ কৃষি সাংবাদিক ফোরাম (বিএজেএফ) ও বণিক বার্তা এর যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের ৫০ বছর কৃষির রুপান্তর ও অর্জন শীর্ষক কৃষি সম্মেলনে বক্তারা এসব কথা বলেন। রোববার (২৪ অক্টোবর) রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে দিনব্যাপী এ কৃষি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকি ও বাংলাদেশের ৫০ বছর পুর্তিতে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

দুই অধিবেশনে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনে উদ্বোধনী অধিবেশনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক ও বিশেষ অতিথি ছিলেন ইউএসএআইডি বাংলাদেশ এর মিশন ডিরেক্টর ক্যাথরিন ডেভিস স্টিভেন্স ও এফএও এর কান্ট্রি রিপ্রেজেনটিভ রবার্ট ডি সিম্পসন। দ্বিতীয় অধিবেশনে প্রধান অতিথি ছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ও বিশেষ অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম। অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন বণিক বার্তার সম্পাদক ও প্রকাশক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ।

সঠিক পরিসংখ্যানের গুরুত্ব তুলে ধরে দ্বিতীয় অধিবেশনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাণিজ্য মন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, আমাদের পরিসংখ্যানে ঝামেলা আছে। গত বছর এক কোটি ৬ লাখ মে. টন আলু উৎপাদন হয়েছিল। আমাদের চাহিদার কথা বলা হয়, ৭০ থেকে ৭৫ লাখ টন। এ হিসাবে ২৫ থেকে ৩০ লাখ টন আলু বাড়তি থাকার কথা। সে সময়ে রপ্তানী বন্ধ ছিল। তারপরও আমাদের ঝামেলা হয়েছিল। তখন আমরা বুঝতে পারি নাই প্রকৃতপক্ষে আমাদের উৎপাদন কম হয়েছে না চাহিদা বেশি ছিল। এ হিসাবটা আমাদের সঠিকভাবে আসে নাই।

পেঁয়াজের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের দেশে পেঁয়াজের চাহিদা ২৪ থেকে ২৫ লাখ টনের মতো। এর বিপরীতে আমাদের উৎপাদন হয়েছে ৩০ লাখ টনের বেশি। তারপরও আমদানি করতে হয়। কারণ মোট উৎপাদিত পেঁয়াজের প্রায় ২০ ভাগ পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যায়।  আবার যেটুকু আমদানি করতে হয় তার ৯০ ভাগ পেঁয়াজ ভারত থেকে আমদানি করা হয়। ভারতে যখন সমস্যা তৈরি হয় আমাদের দেশেও একই সমস্যা দেখা দেয়। এখানে আমাদের উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি চাহিদার সঠিক হিসাবটাও থাকা দরকার।

সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসেই মূলত পেঁয়াজ নিয়ে সমস্যাটা হচ্ছে। এ সময়ে পেঁয়াজের উৎপাদন করা যায় কিনা এবং উৎপাদিত পেঁয়াজের যথাযথ সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া যায় কিনা সে বিষয়ে কাজ করার দরকার আছে। মাছে আমাদের ব্যপক বিপ্লব হলেও গরুর মাংস বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। এখানে আমরা যদি আমদানির অনুমতি দেই তাহলে দেশের ডেইরি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এজন্যে ভোক্তাদের একটু কষ্ট হলেও আমরা স্থানীয় উৎপাদন দিয়ে চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করছি।

প্রথম অধিবেশনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর। আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এসিআই এগ্রিবিজনেস এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী ড. এফ এইচ আনসারী, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক মো. হামিদুর রহমান, আকিজ গ্রুপের চেয়ারম্যান শেখ নাসির উদ্দিন।

দ্বিতীয় অধিবেশনে মূল প্রবন্ধ উপস্থান করেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর আলম। এ সময়ে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ প্রাণি সম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট এর সাবেক মহাপরিচালক ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম, মৎস্য অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক ড. সৈয়দ আরিফ আজাদ, মাল্টি মোড গ্রুপের চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টু, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা ও আফতাব বহুমুখি ফার্মস লিমিটেড এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু লুৎফে ফজলে রহিম খান।

উদ্বোধনী অধিবেশনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, করেনা মহামারী সত্বেও এদেশের মানুষ না খেয়ে নেই। এ সময়ে আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ পুষ্টিকর ও নিরাপদ খাদ্যের যোগান দেয়া এবং কৃষির আধুনিকায়ন করা। বিশে^র বিভিন্ন দেশে জনপ্রতি প্রায় ২০০ গ্রামের চাল খেয়ে থাকেন। কিন্তু আমাদের দেশে চাল খাওয়ার পরিমাণ প্রায় ৪০০ গ্রাম। এটা কমিয়ে আনতে পারলে আমাদের যে চালের উৎপাদন সেটাকে টেকসই পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম প্রক্রিয়াজাত কৃষি পণ্য রপ্তানী করে বড় আয় করে। কিন্তু আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। আমাদের স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে আর্ন্তজাতিক বাজারে প্রবেশ করতে হবে। এ জন্যে কৃষির আধুনিকায়নের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়াতে হবে। ফলের উৎপাদন বিষয়ে তিনি বলেন, একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ শীত না পরলে আপেল গাছে ফুল আসে না। একসময়ে স্ট্রবেরিও হতো না আমাদের দেশে। এখন অনেক ভালো মানের স্ট্রবেরি উৎপাদন হচ্ছে। আগামী ৫ থেকে ৬ বছরের মধ্যে এদেশে সারাবছর আম পাওয়া যাবে এমন পরিকল্পনা নিয়ে আমরা কাজ করছি।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেন, আমাদের কৃষিতে বৈচিত্র্যায়ন হয়েছে, বাণিজ্যিকীকরণ হচ্ছে। আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। কিন্তু এ কথা ঠিক এখনো আমরা আমাদের সমমানের দেশগুলো যেমন ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ডসহ বেশ কিছু দেশের তুলনায় আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। সরকার কৃষির উন্নয়নে বিশেষ করে ধানের ক্ষেত্রে প্রচুর সহযোগিতা দিচ্ছে। তারপরেও আমাদের উৎপাদনশীলতা অনেক কম। আমরা যখন হেক্টরপ্রতি ২.৪৪ মে.টন চাল উৎপাদন করছি সেখানে একই পরিমাণ জমিতে ভিয়েতনাম ৫.৯ মে.টন চাল উৎপাদন করছে। অর্থাৎ আমরা প্রযুক্তিগতভাবে অনেক পিছিয়ে আছি। যেটা পেঁয়াজ রসুনের আকার দেখলেই বুঝা যায়। এসডিজি লক্ষ্য মাত্রা পূরুণ করতে হলে আমাদের দ্রুত সময়ের মধ্যে উৎপাদনশীলতা দ্বিগুণ করতে হবে। ফসলের প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হবে।

বাজার নিয়ে তিনি বলেন, বাজারে কোনা কিছুর দাম বাড়লেই মধ্যস্বত্যভোগীদের দৌড়াত্বের কথা বলা হয়। কিন্তু এটা ঠিক না। কারণ বাজারে কোনো কিছুর দাম বাড়লে নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় এটার সরবরাহ কম। মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে দাম বেঁধে দেয়া ঠিক না। ক্ষুদ্রায়তনের কৃষি দিয়ে আমরা খুব বেশি দূর যেতে পারবো না। আমাদের কাঠামোগত পরিবর্তন করতে হবে। কৃষিকে বাণিজ্যিকীকরণ করা জরুরি। বাণিজ্যিকীকরণে না যেতে পারলে আমাদের ক্ষুদ্রায়তনের কৃষিতে বীমা সুবিধা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না।

অনুষ্ঠানে অনান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন রশিদ গ্রপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবদুর রশিদ, দি মেটাল প্রাইভেট লিমিটেড ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. সাদিদ জামিল, সাবেক সচিব আনোয়ার ফারুক, সুপ্রিম সীড কোম্পানি লিমিটেডের চেয়ারম্যান মো. মাসুম, বাংলাদেশ ক্রপ প্রোটেকশন এ্যাসোসিয়েশন (বিসিপিএ) এর সাবেক চেয়ারম্যান রুমান হাফিজ, কৃষি মন্ত্রনালয়ের সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. বেনজীর আলম, কৃষি বিপনন অধিদফতরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ ইউসুফ, বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাষ্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) সভাপতি ও প্যারাগন গ্রপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মসিউর রহমান।